বাবা, মা আর কুণাল ছাড়া আমার ঝগড়া করা এবং রাগ দেখানোর আরেকটি লোক হলো আমার দিদি।আজ দিদি ফেসবুকএ আমাদের দুজনের ছোটবেলার একটা ছবি পোস্ট করায় ছোটবেলার অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল আর সেই স্মৃতি চারণ করতেই আমার এই লেখা।
আমি যখন জন্মাই দিদি তখন বছর চারেকের। মা এর কাছে শুনেছি মা নাকি যখন ভোরবেলা স্কুলএ চলে যেত আমার দুধের বোতলটা তৈরী করে দিদির হাতে ধরিয়ে দিলে ওই আমায় দুধ খাইয়ে দিত।
দিদি আর আমি দুজনে খুবই বিপরীত স্বভাবের সেই ছোট থেকেই। দিদি যতোটাই শান্ত আমি ততটাই দুষ্টু। এই বয়সে নিজেকে দুষ্টু বলাটা কতখানি ঠিক জানি না তবে এখনো মা তো তাই বলে। আর আমার নিজের মেনে নিতেও কোনো অসুবিধা নেই। আমি নি:সন্দেহে খুব পাজি। ছোটবেলায় আমাদের খুব ঝগড়া ঝাটি এমনকি মারামারিও হত। মারামারি টা তবে আমিই শুরু করতাম। তার পর দিদি যখন আমার একটা হাত ধরে বেঁকিয়ে ধরত তখন আমি মা মা করে চিত্কার করতাম। গায়ের জোড়ে কোনো দিনই পেরে উঠতাম না। চুল ধরে টানাটানিও হয়েছে অনেক যাকে বলে চুলোচুলি। আমার কত চুল যে দিদি তুলে দিয়েছে তাই বোধয় চুলের আজ এই অবস্থা।
জয়পুর বেড়াতে গিয়ে একটা লেপ কেনা হয়েছিল মনে আছে। লাল হলুদ রঙের সাটিন এর লেপটা দেখতেও যেমন সুন্দর ছিল, তেমনই ছিল বিশাল বড়। অনায়াসে দুজন গায়ে দিয়ে শোয়া যেত। কিন্তু লেপটা কেনার পর থেকেই আমি ওটা কাউকে নিতে দিতাম না। নিজে একা গায়ে দিয়ে শোব বলে খুব ঝামেলা করতাম। একদিন ও দিদিকে নিতে দিতাম না। দিদিরও খুব ইচ্ছে করত ওটা নিতে কিন্তু আমি খুব জেদাজেদি করতাম। এই নিয়ে অনেক বকাও খেয়েছি মা এর কাছে। আর যেই একটু গরম পরে যেত তখুনি ভালো মানুষের মতন দিদি কে বলতাম " এবার তুই লেপটা গায়ে দে" ।
যেই একটু বড় হলাম মানে যখন দুজনের জামার সাইজ এক, তখন শুরু হলো আরেক বিপদ। দিদি খুব বলত দুজন দুজনের জামা এক্সচেঞ্জ করে পরার কথা। আমি আনন্দের সঙ্গে ওর জামা গুলো পরে বেরোতাম কিন্তু আমার জামা গুলো দিদি পরলেই ঝামেলা করতাম। আর দিদি খালি বলত " কি হিংসুটে রে তুই, একটুও শেয়ার করতে শিখলি না "।
আরেকটা জিনিস নিয়ে খুব ঝগড়া হত সেটা হলো দুপুরবেলা মা এর পাশে কে শোবে। আমি কিছুতেই দিদিকে মা এর পাশে শুতে দিতাম না। এমনকি মা কে মাঝখানেও শুতে দিতাম না।
তবে এত ঝগড়া মারপিট খুনশুটির মাঝেও কিন্তু ছিল একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক। একই ঘরে দুজনে থাকতাম এবং দুজনের দুটো পড়ার টেবিল ছিল। আমাদের ঘরটা ছিল তিন তলায় আর মা বাবা থাকত এক তলায়। পড়তে বসেই শুরু হত দুজনের গল্প। সারাদিন স্কুলএ কি হলো , এটা ওটা আর যেই সিঁড়ি দিয়ে মা এর পায়ের আওয়াজ পেতাম অমনি দুজনেই চুপ। মা বুঝতে পেরে একদিন কোনো শব্দ না করেই যখন ঘরে ঢুকে পড়ল সেদিন কপালে জুটেছিল ভীষণ বকুনি আর তার পরেই দুজনের পড়ার জায়গা হয়ে গেল আলাদা।
জীবনের একুশটা বছর এক ঘরে এক সঙ্গে কাটিয়েছি দিদির সঙ্গে। তার পর আমি চলে গেলাম বাইরে পড়তে আর কিছু দিন পর হয়ে গেল দিদির বিয়ে। তার পর থেকে আর কটা রাত যে এক সাথে কাটিয়েছি সেটা গুণে বলে দেওয়া যায়। এখন দেখা হলে সারা রাত কেটে যায় গল্প করতে। গত পাঁচ বছর তো এক শহরেই থাকা হয়না। এখন সপ্তাহে একটা দিন স্কাইপিতে কথা বলার জন্য অধীর ভাবে অপেখ্যা করে থাকি। অনেক সময় নিজেদের ব্যস্ততার কারণে সপ্তাহে এক দিনও হয়ত কথা বলা হয়ে ওঠে না।
কোথায় হারিয়ে গেল সেই ছোটবেলা। কোথায় হারিয়ে গেল সেই ঝগড়া মারপিট আর খুনসুটি করা। ভীষণ মিস করি সেই সব দিন গুলো। ছোটবেলায় মনে হত কবে বড় হবো আর আজ মনে হয় ছোটবেলাটাই ছিল সবচেয়ে ভালো।
No comments:
Post a Comment