প্রাণ হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা আগে অনেক শুনেছিলাম কিন্তু সত্যিই নিজের জীবনে যে এরকম একটা অভিজ্ঞতা কোনদিন হবে স্বপ্নেও ভাবিনি। ১৯৯৯ সালে গরমের ছুটিতে আমরা ভূটান বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার এক মামাত দাদা তখন কর্ম সূত্রে ফুন্টসিলিংএ পোস্টেড্। ফুন্টসিলিং থেকে পারো থিম্পু ঘুরে আবার ফুন্টসিলিংএ ফিরে এসেছিলাম। যেদিন ফিরলাম তার পরের দিন ছিল আমাদের ট্রেন, নিউ আলিপুর দুয়ার থেকে। কিন্তু সেই রাত থেকেই শুরু হলো ভয়ঙ্কর বৃষ্টি।
দাদার বাড়ির ঠিক পিছন দিয়েই বয়ে গেছিল তর্ষা নদী। যেদিন পৌঁছলাম সেদিন আমরা রীতিমত পায়ে হেঁটেই নদী এপার অপার করেছিলাম। কিন্তু সেই বৃষ্টির রাতে টের পেয়েছিলাম শান্ত নদীও যে এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। রাতে শুয়ে আমাদের কারুরই ঘুম আসছিল না। নদীর উপর পাথর ভেঙ্গে পড়ার সে কি সাংঘাতিক আওয়াজ। পর দিন সকালে আমরা যখন রওনা দিলাম তখন বাড়ি থেকে বেড়িয়েই মনে হয়েছিল আদৌ কি আমরা স্টেশনএ পৌঁছতে পারব? ভূটান পার হয়েই ভারতের যে জায়গাটা তার নাম জয়গা। দেখলাম ভূটান আর ভারতের মাঝখানের রাস্তাটা ভেঙ্গে গিয়ে নদীর জল বইছে। আর সেই জলের স্রোতে যদি কেউ ভেসে যায় তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা। যে ভাবেই হোক রাস্তা পার হতে না পারলে স্টেশন পৌঁছন যাবে না। দেখা গেল কিছু স্থানীয় লোক এক ধরণের ট্রলি গাড়ি করে লোকজনকে পারাপার করতে সাহায্য করছে। সাধারণত ওই গাড়িতে শাক সবজি ফল এসব বোঝাই করা হয়। অবাক লাগলো দেখে যে এই মানুষগুলো তাদের নিজেদের জীবন বিপন্ন করে অন্যকে সাহায্যের হাত বাড়িযে দিয়েছে। আমরাও অগত্যা ওই গাড়িতে চেপে ভাঙ্গা রাস্তা পার হলাম। জলের স্রোতে একবার গাড়িটা অন্য দিকে ঘুরে যাওয়ায় এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল এখানেই জীবন শেষ কিন্তু তখনও অনেক বাকি। ভগবান আড়ালে হাসছিলেন নিশ্চই। ।গাড়ি ঠিক করাই ছিল। কোনো রকমে রাস্তার এপারে এসে আমরা গাড়িতে করে নিউ আলিপুর দুয়ার স্টেশনএ যদিও বা পৌঁছলাম, গিয়ে জানতে পারলাম আমাদের ট্রেন অর্থাৎ কামরূপ এক্সপ্রেস বাতিল করা হয়েছে কারণ ট্রেন ছাড়ার আগেই ট্রেনএ বোমা পাওয়া গেছে। পরের কোনো ট্রেনএ বিনা রিসার্ভেসান ছাড়া যাওয়া সম্ভব নয়, এদিকে উত্তর বঙ্গে বন্যা শুরু হয়ে গেছে তাই কোনো হোটেলে না থেকে সেখান থেকে বেড়িয়ে পরাই মঙ্গল। এই ভেবে ডিসিশন নেওয়া হলো যে বাসে করে কলকাতা যাওয়া হবে। তখন কে জানত বিপদ আমরা নিজেরাই ডেকে আনছি।
ফোন করে জানা গেল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কলকাতা যাবার একটা বাস ছাড়ছে , সেটা ছিল উত্তর বঙ্গ স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পরেসনের বাস। আমরা তরিঘড়ি রিকশা করে মাল পত্র নিয়ে বাস গুমটিতে পৌঁছলাম। দেখা গেল বাসে মাত্র বারো জন যাত্রী। আমরাই ছিলাম আট জন। বাসে উঠে প্রথমেই দেখলাম কথা থেকে যেন জল পড়ছে। ওরে বাবা, এ যে বাসের ছাদ ফুটো আর সেখান থেকেই পড়ছে জল। যাই হোক বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ পর আমরা লক্ষ্য করলাম যে বাসটা একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ব্যপারটা জানার জন্য যখন বাসের হেল্পারকে জিগ্গেস করা হলো, সে বলল বাসের ব্রেকটা একটু গন্ডগোল করছে তাই আরকি টেস্ট করা হচ্ছে। হে ভগবান , এই অবস্থা সরকারী বাসের। নামারও উপায় নেই চারিদিকে বন্যার জল। সেই সময় ভগবানের নাম করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। অতি বড় নাস্তিকও তখন ভগবানকে ডাকবে। উত্তর বঙ্গে বন্যার খবর আমরা কাগজে পরেছি বা টিভিতে দেখেছি কিন্তু সেই বন্যা নিজের চোখে দেখে বুঝেছিলাম কতটা ভয়ানক। এক একটা ব্রিজের উপর দিয়ে যখন বাস যাচ্ছে মনে হচ্ছিল এই বুঝি ভেঙ্গে পড়বে। এমনি অবস্থা সেই সব ব্রিজের যে একটা গাড়ি এপার থেকে ওপারে গেলে তবেই আরেকটা গাড়ি ব্রিজে উঠছে, মানে দুটো গাড়ি এক সাথে ব্রিজে উঠলেই ভেঙ্গে পড়ার সম্ভবনা। আর ভেঙ্গে পরলেই পড়তে হবে সোজা নদীর জলে। মোটামোটি আমি সারা রাস্তা চোখ বন্ধ করেই ছিলাম, কারণ চোখ খুললেই সেই ভয়ানক বন্যার ছবি ভেসে উঠছিল।
এর মধ্যে একবার বাসটা খারাপ হয়েছিল। কি জানি গাড়ির ইঞ্জিনে কি যেন সমস্যা হয়েছিল কিন্তু ড্রাইভার সেটা তাড়াতাড়ি ঠিক ঠাক করে বেশ জোড়েই বাস চালাতে শুরু করলো। বিপদ অনেকটা কেটে গেছে। প্রায় সন্ধ্যে আটটা নাগাদ আমরা শিলিগুড়ি পৌঁছলাম। সেই কোন সকালে বেড়িয়েছিলাম , খাওয়া দাওয়া কিছুই হয়নি। শিলিগুড়ি পৌঁছে তড়কা রুটি খেয়ে মনে হচ্ছিল কতদিন পর আবার খেলাম। আমরা ছাড়া বাকি যাত্রীরা শিলিগুড়িতেই নেমে গেল আর কিছু নতুন যাত্রী আবার বাসে উঠলো। বাস আবার চলতে শুরু করলো। রাতে সবে যখন চোখ লেগেছে আমাদের, ঠিক সেই সময় বাসটা ভীষণ জোড়ে ব্রেক মেরে থেমে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখন বাজে প্রায় রাত দুটো। বাসের চাকা ফেটে গেছে। । রাস্তা ঘুটঘুটে অন্ধকার। সবাই বলল এলাকাটা ভালো নয় , কেউ যেন বাস থেকে না নামে। কি কান্ড, এদিকে আবার অন্ধকারে চাকা বদলাবে কি করে? অগত্যা বাবা টর্চ নিয়ে বাস থেকে নামল, ড্রাইভার চাকা বদলালো টর্চের আলোয়। মনে মনে ভয় হলো কি জানি চাকাটা ঠিক ঠাক লাগলো কিনা। হয়ত দেখব ঘুমের মধ্যেই সবাই শেষ। যাই হোক আবার বাস চলতে শুরু করলো, কিন্তু এবার বেচারা আর টানতে পারল না। ভোর চারটে নাগাদ মালদার কাছাকছি একটা জায়গায় এসে বাস একদম বন্ধ হয়ে গেল এবং ড্রাইভার হাত তুলে নিয়ে বললো বাস আর চলবে না, গ্যারেজএ নিয়ে যেতে হবে। আমরা মাল পত্র নিয়ে একেবারে রাস্তায়। সেটা ছিল একটা হাইওয়ে। একটা খড়ের গাদার উপর বসে আছি সবাই। তবে ড্রাইভার এর কি জানি দয়া হলো, বলল যে সে কোনো কলকাতাগামী বাস দেখলে দাঁড় করিয়ে আমাদের তুলে দেবে। অবশেষে কিছুক্ষণ পর একটা বাসে আমরা উঠলাম যেটা একদম কলকাতার উল্টডাঙ্গায় এসে পৌঁছবে।
আমাদের প্রায় চব্বিশ ঘন্টা জার্নি করা হয়ে গেছে, সবাই ভীষণ ক্লান্ত, শুধু অপেক্ষা কখন বাড়ি পৌঁছব। এই বাসটা ছিল একটা লোকাল বাস। প্রচন্ড ভিড়, ক্রমাগত লোকজন উঠছে নামছে। আমরা কজন বসার জায়গা পেয়েছিলাম বটে কিন্তু হঠাত দেখি আমার পাশে একজন লোক বসে আছে আর তার থলি থেকে দুটো মুরগি উঁকি মারছে। এটা দেখেই আমার অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল। তার উপর একটা ট্রাফিক জ্যামএ বাসটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে । পাশে দাঁড়িয়েছিল পাকা আম বোঝাই ওরা একটা ট্রাক। মালদায় তখন চল্লিশ ডিগ্রী গরম। ওই গরমে আমের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠেছিল । আমাদের কারুরই তখন আর কথা বলবারও শক্তি ছিলনা। কৃষ্ণনগর এসে পৌঁছলাম দুপুর দুটোয়। অসম্ভব জোড়ে বাস চলছিল। মনে হচ্ছিল যেকোনো মুহুর্তে কোনো সামনের গাড়িতে বা একটা গাছে ধাক্কা লেগে সবাই প্রাণ হারাব। যাই হোক প্রাণ হারাতে হয়নি। সে যাত্রায় আমরা সবাই বেঁচেই বাড়ি ফিরলাম।
এতটাই ঘোরে ছিলাম যে বাড়ি ফিরে দরজায় ঢোকার সময় মনে হলো বাড়ির পাশটা এত সাদা লাগছে, এই গরমে কলকাতায় এখন আকাশে কুয়াশা কথা থেকে এলো? আসলে সেটা কুয়াশা নয়, পাশের বাড়িটা ভেঙ্গে প্রমোটিং হবে, যাবার সময় দেখেছিলাম বাড়িটা ভাঙ্গছিল এসে দেখলাম পুরো ভাঙ্গা হয়ে গেছে আর সেখানটা একদম খাঁ খাঁ করছে। আর মনে মনে ভেবেছিলাম, বর্ষায় কোনো দিন আর পাহাড়ে বেড়াতে যাব না।
এর মধ্যে একবার বাসটা খারাপ হয়েছিল। কি জানি গাড়ির ইঞ্জিনে কি যেন সমস্যা হয়েছিল কিন্তু ড্রাইভার সেটা তাড়াতাড়ি ঠিক ঠাক করে বেশ জোড়েই বাস চালাতে শুরু করলো। বিপদ অনেকটা কেটে গেছে। প্রায় সন্ধ্যে আটটা নাগাদ আমরা শিলিগুড়ি পৌঁছলাম। সেই কোন সকালে বেড়িয়েছিলাম , খাওয়া দাওয়া কিছুই হয়নি। শিলিগুড়ি পৌঁছে তড়কা রুটি খেয়ে মনে হচ্ছিল কতদিন পর আবার খেলাম। আমরা ছাড়া বাকি যাত্রীরা শিলিগুড়িতেই নেমে গেল আর কিছু নতুন যাত্রী আবার বাসে উঠলো। বাস আবার চলতে শুরু করলো। রাতে সবে যখন চোখ লেগেছে আমাদের, ঠিক সেই সময় বাসটা ভীষণ জোড়ে ব্রেক মেরে থেমে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখন বাজে প্রায় রাত দুটো। বাসের চাকা ফেটে গেছে। । রাস্তা ঘুটঘুটে অন্ধকার। সবাই বলল এলাকাটা ভালো নয় , কেউ যেন বাস থেকে না নামে। কি কান্ড, এদিকে আবার অন্ধকারে চাকা বদলাবে কি করে? অগত্যা বাবা টর্চ নিয়ে বাস থেকে নামল, ড্রাইভার চাকা বদলালো টর্চের আলোয়। মনে মনে ভয় হলো কি জানি চাকাটা ঠিক ঠাক লাগলো কিনা। হয়ত দেখব ঘুমের মধ্যেই সবাই শেষ। যাই হোক আবার বাস চলতে শুরু করলো, কিন্তু এবার বেচারা আর টানতে পারল না। ভোর চারটে নাগাদ মালদার কাছাকছি একটা জায়গায় এসে বাস একদম বন্ধ হয়ে গেল এবং ড্রাইভার হাত তুলে নিয়ে বললো বাস আর চলবে না, গ্যারেজএ নিয়ে যেতে হবে। আমরা মাল পত্র নিয়ে একেবারে রাস্তায়। সেটা ছিল একটা হাইওয়ে। একটা খড়ের গাদার উপর বসে আছি সবাই। তবে ড্রাইভার এর কি জানি দয়া হলো, বলল যে সে কোনো কলকাতাগামী বাস দেখলে দাঁড় করিয়ে আমাদের তুলে দেবে। অবশেষে কিছুক্ষণ পর একটা বাসে আমরা উঠলাম যেটা একদম কলকাতার উল্টডাঙ্গায় এসে পৌঁছবে।
আমাদের প্রায় চব্বিশ ঘন্টা জার্নি করা হয়ে গেছে, সবাই ভীষণ ক্লান্ত, শুধু অপেক্ষা কখন বাড়ি পৌঁছব। এই বাসটা ছিল একটা লোকাল বাস। প্রচন্ড ভিড়, ক্রমাগত লোকজন উঠছে নামছে। আমরা কজন বসার জায়গা পেয়েছিলাম বটে কিন্তু হঠাত দেখি আমার পাশে একজন লোক বসে আছে আর তার থলি থেকে দুটো মুরগি উঁকি মারছে। এটা দেখেই আমার অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল। তার উপর একটা ট্রাফিক জ্যামএ বাসটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে । পাশে দাঁড়িয়েছিল পাকা আম বোঝাই ওরা একটা ট্রাক। মালদায় তখন চল্লিশ ডিগ্রী গরম। ওই গরমে আমের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠেছিল । আমাদের কারুরই তখন আর কথা বলবারও শক্তি ছিলনা। কৃষ্ণনগর এসে পৌঁছলাম দুপুর দুটোয়। অসম্ভব জোড়ে বাস চলছিল। মনে হচ্ছিল যেকোনো মুহুর্তে কোনো সামনের গাড়িতে বা একটা গাছে ধাক্কা লেগে সবাই প্রাণ হারাব। যাই হোক প্রাণ হারাতে হয়নি। সে যাত্রায় আমরা সবাই বেঁচেই বাড়ি ফিরলাম।
এতটাই ঘোরে ছিলাম যে বাড়ি ফিরে দরজায় ঢোকার সময় মনে হলো বাড়ির পাশটা এত সাদা লাগছে, এই গরমে কলকাতায় এখন আকাশে কুয়াশা কথা থেকে এলো? আসলে সেটা কুয়াশা নয়, পাশের বাড়িটা ভেঙ্গে প্রমোটিং হবে, যাবার সময় দেখেছিলাম বাড়িটা ভাঙ্গছিল এসে দেখলাম পুরো ভাঙ্গা হয়ে গেছে আর সেখানটা একদম খাঁ খাঁ করছে। আর মনে মনে ভেবেছিলাম, বর্ষায় কোনো দিন আর পাহাড়ে বেড়াতে যাব না।
No comments:
Post a Comment