Monday 29 June 2015

শিমুলতলায় ভূতের ভয়

 ঘুমের আগে রেডিও শোনাটা খুব ছোট থেকেই  অভ্যেস।  কলকাতা ছাড়ার পর রেডিও  শোনাও ছেড়ে দিয়েছি।  কিন্তু ঘুমের আগে হয় গান বা নাটক কিছু একটা না শুনলে আমার ঘুম আসেনা। তাই কদিন ধরেই রাতে শুতে যাবার আগে সানডে সাসপেন্স শুনছি ইউটুবেএ।  ঘর অন্ধকার করে শুয়ে শুয়ে ভুতের গল্প শুনতে যে এত ভালো লাগে তা আগে জানতাম না।  গতকাল রাতে এমনি একটা ভুতের গল্প শুনতে শুনতে মনে পরে গেল আমার ছোটবেলায়  শিমুলতলায় বেড়াতে যাবার কথা।  বছরটা ঠিক মনে পরছে না, তবে আমি তখন  সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি।  প্রতি বছর আমরা পুজোর সময় কলকাতা ছেড়ে কোথাউ না কোথাউ বেড়াতে যেতাম। তা সেবার মনে আছে ঠিক হলো  শিমুলতলা যাবার।  উদ্যোক্তা  ছিলেন আমার বাবার এক বন্ধু।  ঠিক হলো অষ্টমীর দিন রওনা দেব আমরা। 
আমরা সর্বসাকুল্যে ছিলাম আট জন।  আমি, বাবা, মা ও  দিদি আর আমার বাবার বন্ধুর পরিবার। তারা ছিল আরো চারজন।  মনে আছে ছোটবেলায় কোথাউ বেড়াতে যাবার সময়  যাবার আগের দিন গুলো ছিল ভীষণ আনন্দের।   বিশেষ করে মা যখন সুটকেস  বার করে গোছগাছ শুরু করত।  সেবারেও ঠিক তেমনি আমরা হই হই করে গোছগাছ শুরু করে দিলাম কিন্তু যাবার দিন তুমুল বৃষ্টি। মনে আছে বাড়ির সামনে অবধি ট্যাক্সি আসেনি, আমরা মাল পত্র নিয়ে জল পেরিয়ে বড় রাস্তা থেকে ট্যাক্সি ধরেছিলাম। মানে যাত্রার শুরুটাই কেমন যেন এলোমেলো হলো।  যাই হোক আমরা  কোনরকমে শিয়ালদাহ স্টেশনএ পৌঁছে দেখি প্লাটফর্মে কি সাংঘাতিক ভিড়। মুজ্জাফারপুর এক্সপ্রেস ছিল, কেউ কোনো রিসারভেসন মানছিল না।  আমাদের রিসারভেসন থাকা সত্তেও কোনরকমে ট্রেন এর কামরার ভিতরে যে যার মত ঠেলেঠুলে জায়গা করে বসতে হলো। এত ভিড় ছিল যে বাড়ি থেকে করে নিয়ে যাওয়া লুচি তরকারী সব বাগের ভিতরেই নেতিয়ে গেল।  

যাই হোক কোনরকমে আমরা শিমুলতলা স্টেশনএ পৌঁছে সবাই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। শিমুলতলায় থাকার জন্য একটি পুরনো বাড়ি ঠিক করা হয়েছিল। বাড়ির মালিক থাকে কলকাতায় আর ওনার শিমুলতলার বাড়িটিকে  গেস্ট হাউস  হিসেবে ভাড়া  দেন।  কিন্তু  কি বিপদ, বাড়িটিতে পৌঁছে জানা গেল যে ওখানে কোনো ইলেকট্রিসিটি নেই।  মানে রাস্তার যে পারে আমাদের থাকার কথা ঠিক সেই দিকেই নাকি ইলেকট্রিসিটি পৌঁছয়নি কিন্তু রাস্তার অন্য পারেই আলো।
আমরা ভেবেই পেলাম না যে কি করে দিন  চারেক বিনা ইলেকট্রিসিটি তে আমরা থাকব।  কিন্তু উপায় নেই, এসে যখন পরেছি তখন বাকি কটা  দিন থাকতেই হবে।  আর পুজোর সময়, অক্টোবর মাস তখন, গরম তো ছিলই না বরং একটু ঠান্ডা ঠান্ডা পড়ে গেছিল তাই পাখার প্রয়োজন তেমন ছিল না। আর সন্ধের পর  হারিকেনের আলো আর আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া টর্চ ছিল ভরষা। 

 একটি রান্নার লোক মজুত ছিল।  সন্ধেবেলা ওই ভিড় ট্রেনএ না খেয়ে দেয়ে আমরা যখন পৌঁছলাম আর যখন সেই রাঁধুনি আমাদের ভাত আর মুরগির ঝোল রেঁধে দিল, সেই খেয়ে মনে হলো যেন অমৃত। বাড়িটার বর্ণনা দিতে ভুলেই গেছি।  প্রায় দু তিন বিঘে জমি নিয়ে বিশাল একখানা বাড়ি আর বাড়িটার চারিদিকে ফল ফুলের বাগান মানে সমস্ত জমির ঠিক মাঝখানে বাড়িটা। পাশের বাড়িটা ছিল অনেক দূরে।  বাড়িটার যে দিকটা গেস্ট হাউস সেখানে মোট তিনটি ঘর আর প্রত্যেকটা ঘরের মধ্যে দিয়ে প্রত্যেকটা ঘরে যাওয়া যায়।  ঠিক হলো প্রথম ঘরটিতে কাকু তার ছেলে কে  নিয়ে শোবেন, দ্বিতীয় ঘরটি তে আমার বাবা একা শোবেন আর শেষের ঘরটি তে আমরা সব মেয়েরা শোব। যাই হোক খাওয়া দাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে আমরা যখন শুতে গেলাম তখন বেশ রাত।  আমাদের ঘরের জানালাটা খুলে রাখা হয়েছে, আমি শুয়ে শুয়ে দেখছিলাম চাঁদের  আলোটা কি ভাবে যেন বাড়ির পিছনের বড় বড় গাছগুলোকে ভেদ করে আমাদের বিছানায় এসে পড়েছে। শোবার কিছুক্ষণ পড়েই কিসের যেন একটা শব্দ হলো।  আমি শুনলাম , আর কেউ শুনলো কিনা ঠিক বুঝতে পারলাম না।  আমি জানালার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছি আচ্ছা কেউ যদি ঢুকে থাকে তাহলে সে কি ওই  জানলাটা দিয়ে ঢুকলো কারণ দরজা তো বন্ধ।  তার পর ভাবলাম ভূত নয় তো, কারণ সাধারণত গল্পের বইতে এরকম অনেক পড়েছি।  সবাই  চুপচাপ শুয়ে আছে দেখে আমিও আর কিছু বললাম না।  কিন্তু আওয়াজটা আবার একবার হলো।  খুটখাট খুটখাট একটা শব্দ। পাশে মা শুয়ে ছিল, আর পারলাম না, জিগ্গেস করলাম কিছু শুনতে পেলে।  মা বলল হ্যা। তার পর আমাদের গলার আওয়াজ পেয়ে বাকিরাও যারা ওই ঘরেই ছিল বলল সবাই একটা শব্দ শুনতে পাছে।  আওয়াজটা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো, মনে হলো ঘরের মধ্যে দিয়ে কে যেন হেঁটে যাচ্ছে।  কি ভয়ংকর ব্যপার , আমরা সবাই কাঠ হয়ে শুয়ে রইলাম। তার পর মনে হলো কে যেন আমাদের ব্যাগ খুলছে বা ব্যাগ থেকে কিছু বার করছে। মনে হলো চোর  নাকি  তাহলে তো  আর চুপ করে থাকা যাবেনা। তখন আমি চিত্কার করে বাবাকে ডাকলাম বাকিরাও  ডাকাডাকি শুরু করলো। বাবা সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘর থেকে টর্চ নিয়ে ছুটে এলো।  না কিছুই তো নেই।  টর্চের আলোয় ঘরে কিছুই তো দেখা গেলনা।  শুধু আলো পরতেই একটা বড় ঈদূর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।  অত বড় ঈদূর আমি আগে কখনো দেখিনি।  রাত আর বেশি বাকি ছিল না কিছুক্ষণ পরই ভোর হয়ে গেল।  
সকাল বেলা উঠে দেখা গেল আমাদের খাবারের ব্যাগটা  পুরো  কাটা আর সমস্ত খাবার মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সমস্ত বিসকুট আর চানাচুরের প্যাকেট গুলো ছেঁড়া।   বোঝা গেল এ সমস্তই  ওই ঈদুর বাবাজির কাজ।  যাকে মনে হচ্ছিল ঘরের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে সে আর কেউ নয় ওই ধেরে ঈদুরটি।  পর দিন সকালে ভূতের রহস্য উদঘাটন হতে সবাই বেশ মজা পেয়েছিলাম তবে বাড়ি থেকে আনা সমস্ত খাবার জলে গেল। 
  
বাকি কটাদিন আমরা বেশ হই হই  করে কাটিয়ে দিলাম। দুর্গাপুজোর ওই দিন গুলোয় কলকাতার রাস্তাগুলি যখন আলোয় ঝলমল করছে, তখন  বিনা  ইলেকট্রিসিটিটে  আমরা কিন্তু বেশ আনন্দ করেই কাটিয়েছিলাম শিমূলতলার সেই ভুতুরে বাড়িটিতে। আর  শিমুলতলার  ওই প্রথম রাতের ঘটনা  চিরকালের মতন স্মৃতিতে  গেঁথে গেল।  

No comments:

Post a Comment